Author Picture

ছারপোকা

সুরাইয়া বেগম

হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চুড়িগুলো দেখছে আলেয়া। নিজের হাতে বানানো চুড়ি! লাল নীল সবুজ রঙের পাথরে জ্বলমল করছে চুড়িগুলো। মনটা কেমন ভালো হয়ে যায় আলেয়ার। আবার একটু বিরক্তিও লাগে। সহকারী ম্যানেজার কুদ্দুস লুকিয়ে লুকিয়ে শুধু ওকেই কেন দিলো? আর তো কাউকে দিলো না? এই চুড়ি জোড়া আলেয়াই বানিয়েছে। কুদ্দুস লুকিয়ে রেখে দিয়েছে আলেয়ার জন্য! কারখানার এই সহকারী ম্যানেজার ব্যাটা বড্ড গা ঘেঁষা। যখন তখন আলেয়ার সাথে কথা বলতে চায়! ব্যাপারটা আলেয়ার মন্দ লাগেনা। মাঝে মাঝে রোকেয়া, আসমা, জরিনা এই নিয়ে খুব ফাজলামি করে আলেয়ার সাথে। আলেয়া হেসেই উড়িয়ে দেয়।

কিরে আলেয়া, লাইট নিবা। ঘুমাইতে পারতাছি না। বেহানে আবার কামে যাওন লাগবো তো! ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে ওঠে রেশমি।

-হ নিভাইতে আছি। বলেই লাইট নিভিয়ে দেয় আলেয়া। তারপর শুয়ে পড়ে।

লালবাগের চেয়ারম্যানের গলির দুই নম্বর গলির এই ঘরটায় শেয়ারে থাকে আলেয়া। মাস তিনেক আগে একরকম পালিয়ে এসেছে গ্রাম থেকে। একই গ্রামের মেয়ে রেশমি আগে থেকেই ঢাকায় কাজ করে। ওর আশ্রয়ে এসে উঠেছে আলেয়া। অল্প বয়স, অবিবাহিতা মেয়ে আর কোথায় থাকবে? এই বাড়িতে মোট ষোল খানা ঘর। ইটের গাঁথুনী দিয়ে তার উপর কাঠের পাটাতন তৈরি করে উপর নিচ মিলিয়ে দুই ভাগে ঘর তৈরি করেছে মালিক। প্রতি ভাগে আটটি করে ঘর। এইরকম একটা ঘরের দোতলার একটা ঘর চার হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছে রেশমি। রেশমির স্বামী রাজমিস্ত্রির কাজ করে পুরান ঢাকায়। চারটি সন্তানের মধ্যে বড় রেশমির মেয়ে কুমকুম। বয়স বারো তের হবে। ছোট্ট এই ঘরটায় নানান জিনিসপত্রে ঠাসাঠাসি। তারমধ্যে ওরা সাতজন মানুষ। ঘরের এককোনে বড় একটা খাট পেতে তার উপর রেশমী স্বামী আর ছেলেদের নিয়ে ঘুমায়। আর মেয়েটাকে নিয়ে আলেয়া নিচে বিছানা পেতে ঘুমায়।

সারাদিন কাজ শেষে বাসায় ফিরে বিছানায় একটু আরাম করে যে ঘুমাবে তার কোন উপায় নাই। বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে কুটকুট করে হাতে পায়ে কিসে যেন কামড়াতেই থাকে। বারবার ঘুম ভেঙে যায় আলেয়ার। ওদিকে রেশমির ছোট ছোট ছেলেগুলোও মাঝরাতে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দেয়। সবাই গা চুলকাতে থাকে এলোপাথাড়ি। অন্যদিকে মরার মতন ঘুমায় রেশমী। সারাদিন ছুটাছুটি করে ঠিকা ঝিয়ের কাজ করে রাতে পড়ে পড়ে ঘুমায়। শেষমেশ আলেয়া উঠে লাইট জ্বালিয়ে খুঁজে পায়না কিছুই। বুঝতে পারে ছারপোকা- নিঃশব্দে কামড় দিয়েই লুকিয়ে পড়ে আড়ালে। তারপর শুরু হয় প্রচন্ড চুলকানি। ছোট ছোট বিচিতে ভরে যায় শরীর। আলেয়া নিজের বিছানা ঝাড়ে, বাচ্চাদের বিছানা ঝেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে। অধোঘুম আধো জাগরণে কেটে যায় রাত।

সামনেই ঈদ। খুব ব্যস্ততা ওদের কারখানায়। মালিক অর্ডার আনে, স্টিলের ফ্রেম তৈরি হয়ে আসে অন্য আরেক কারখানা থেকে। ওরা চল্লিশ পঞ্চাশ জন মেয়ে মিলে ফ্রেমগুলো সাজিয়ে তোলে সুপার গ্লু লাগিয়ে বাহারি পাথর আর লেস দিয়ে। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত চলে কাজ। মাঝখানে একটু সময় দেয়া হয় নামাজ আর ইফতারির জন্য। একজন সুপারভাইজার মেয়ে ঘুরে ঘুরে কাজ দেখে, ভুল হলে বকাঝকা করে। তারপর এই চুড়ি চলে যায় ঢাকার বড় বড় শপিং মল গুলোতে। অন্য আরেকটা রুমে তৈরি হয় কানের দুল আর গলার মালা। তবে সব কানের দুলের সাথে আবার মালা হয়না, কিছু কিছু শুধু দুল তৈরি হয়।

সেহেরি খেয়ে একটু না ঘুমাতেই সাতটা বেজে যায়। দরমর করে উঠে বাথরুমে যেয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় আলেয়ার। প্রতি আট পরিবারে জন্য একটা টয়লেট আর একটা গোসলখানা। সকালে সবাই কাজে বের হয়। যেমন ভীড় টয়লেটে তেমনি গোসল খানায়। একজন টয়লেটে গেলো তো অন্য আরেকজন প্রহর গুনতে থাকে। হয়তো এরই মধ্যে রেশমিও ওঠে রান্না ঘরে চুলায় লাইন দিয়ে থাকে। একে তো গ্যাস থাকেনা সাতটার পর থেকে সেই বেলা তিনটা অবধি তার উপর চার ভাড়াটিয়ার জন্য একটা করে চুলা বরাদ্দ। কোনরকম একটু ভাত আলু সেদ্ধ করে বাচ্চাগুলোর জন্য রেখে যায় রেশমী। টয়লেটের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাই তোলে আলেয়া।

রাতে ফেরার সময় ম্যানেজার সপ্তাহের পনেরশো টাকা বেতন বুঝিয়ে দেয়। আলেয়া টাকা নেবার সময় ম্যানেজার হাবিব যেন ইচ্ছে করেই ওর হাতটা একটু ছুঁয়ে দেয়। আলেয়া ম্যানেজারের চোখের দিকে তাকায়। পান খাওয়া ঠোঁটে বিশ্রী একটা হাসি দেয় হাবিব। আলেয়া টাকা নিয়ে বেরিয়ে আসে কারখানা থেকে। রোকেয়া, আসমা ওদের সাথে রাস্তায় নেমে আসে। সারাদিন রোজা রেখে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকে। তাই সবাই মিলে আইসক্রিম খাবে বলে ঠিক করে। রাস্তার পাশেই একটা কনফেকশনারীতে ঢোকে। পোলারের কাপ আইসক্রিম হাতে নিয়ে খেতে খেতে বের হতে যেয়ে থমকে দাঁড়ায় আলেয়া। মনে হলো জব্বারের মতন একটা ছেলেকে দেখলো! আসমার আড়ালে গিয়ে ভালো করে খেয়াল করে সামনের দোকানটার দিকে। হ্যাঁ তাইতো! ওটা জব্বার। এখানে কেমন করে এলো? ভেবে পায়না আলেয়া। ওর বুকের ভেতর তীব্র হাতুড়ি পেটানোর শব্দ হতে থাকে। ভালো করে আঁচল টেনে মুখ মাথা জড়িয়ে নেয় আলেয়া।

সারাদিন কাজ শেষে বাসায় ফিরে বিছানায় একটু আরাম করে যে ঘুমাবে তার কোন উপায় নাই। বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে কুটকুট করে হাতে পায়ে কিসে যেন কামড়াতেই থাকে। বারবার ঘুম ভেঙে যায় আলেয়ার। ওদিকে রেশমির ছোট ছোট ছেলেগুলোও মাঝরাতে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দেয়। সবাই গা চুলকাতে থাকে এলোপাথাড়ি। অন্যদিকে মরার মতন ঘুমায় রেশমী। সারাদিন ছুটাছুটি করে ঠিকা ঝিয়ের কাজ করে রাতে পড়ে পড়ে ঘুমায়

এক গলি আগেই ওর সঙ্গীরা বিদায় নিলে আলেয়া দ্রুত পা চালায়। হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায় জব্বার। ভয়ে কুঁকড়ে যায় আলেয়া

-তুমি কি ভাবছো? গ্রাম থেইক্যা পলায়া আইস্যা শহরে লুকায়া থাকবা? এত্তো সোজা! আরে যাইবা কই? ঠিক তোমারে আমি বাইর কইরা ফালাইছি।

-পথের থন সইরা খাড়ান। আপনার লগে কোন সম্পর্ক নাই আমার। যান এইখান থোন। একটু উচ্চ স্বরেই বলে ওঠে আলেয়া। থরথর করে কাঁপতে থাকে ওর সমস্ত শরীর।

-তোমারে না লইয়া তো যামুনা আমি। তোমার মামী তোমারে বিয়া দিবো আমার লগে কইয়া টাকা নিছে। অহন তুমি না কইলে ক্যামনে অইবো? টাকাও দিবানা, তোমারেও পামু না? হেইড্যা ক্যামনে অয়!

কোন জবাব দেয়না আলেয়া। বাড়ির গেটের ভিতর ঢুকে যায়। একরকম দৌড়ে ঘরে এসে হাঁফাতে থাকে। রেশমী ছোট ছেলেটাকে ভাত খাওয়াতে থাকে বিছানায় বসে। আলেয়ার এরকম দৌড়ে আসা দেখে একটু অবাক হয়ে জানতে চায়

-কিরে! ভুত দেখছস মনে অয়! অমন কইরা কেউ দৌড়ায় ?

হাতের ব্যাগটা রেখে খাটের কিনারে বসে পড়ে আলেয়া। সমস্ত শরীর দরদর করে ঘামছে, মাথা ঝিমঝিম করছে। কিছুই বুঝতে পারেনা। জব্বার কি করে ওর ঠিকানা পেলো?  কি হবে এখন?

-বুবু রাস্তায় জব্বররে দেখলাম! আমি অহন কই যামু? অয় তো জোর কইরা আমারে ধইরা লয়া যাইবো। কাঁদতে কাঁদতে কোন রকমে জানায় রেশমিকে।

-কস কি? অয় ক্যামনে ঠিকানা পাইলো? নিশ্চয়ই তোর মামী দিছে। হতবাক হয়ে বলতে থাকে রেশমি।

-এহন কি অইবো?

-ভাবিস না, শহরের থোন একটা মাইয়ারে ধইরা নেওন ওতো সোজা না। বাচ্চাকে খাওয়ানো শেষ করে হাত ধুতে ধুতে বলে রেশমী। আঁচলে হাত মুছে আলেয়ার পাশে এসে বসে।

-শোন, তুই দুইদিন আসমার লগে যাইয়া থাক। আর কাইল আমার বোরখা পইরা কামে যাবি। তয়তো অয় তোরে চিনতে পারবো না।

-আসমা তো হের জামাই লইয়া থাহে। যদি আমারে রাখতে রাজি না অয়?

-জামাই আছে তো কি অইছে? তুই এক কোনায় পইড়া থাকবি। দুইদিন তো মোডে। হেরপর আবার আমার লগে থাকবি। সান্তনা দেয় রেশমি।

মনটা অশান্ত হয়ে আছে আলেয়ার। এপাশ ওপাশ করে বিছানায় পিঠ দিয়ে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে রাজাপুর। যেখানে বড় হয়েছে আলেয়া। মামীর ভাইয়ের ছেলে এই জব্বার। আলেয়ার মা মারা যাবার পর নানীর কাছে বড় হয় আলেয়া। মায়ের মুখ মনে করতে গেলে ওর নানীর মুখটাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাবা বলতে যাকে চিনতো, সেই ছোট বেলায় দেখেছে একবার কি দুবার- তারপর শুনেছে বাবা নতুন সংসার পেতেছে চাটগাঁয়।

নানীর আশ্রয়ে আলেয়া খুব আনন্দেই দিন কাটিয়েছে। মামার রোজগারে সংসার চলতো হেসে খেলে। ছোট্ট মুদির দোকান থেকে যা উপার্জন হতো- তিনজন মানুষের বেশ চলে যেতো। আলেয়ার টগবগে কৈশোর যেন চলে গেল এক নিমিষেই। বাড়ন্ত শরীরে যৌবনের আগমন- নানী খুব দুশ্চিন্তায় থাকে নাতনিকে নিয়ে। গরিবের মেয়ের ওতো রূপ যে থাকতে নেই!  এও যে এক অভিশাপ। চোখের আড়াল হতে দেয়না নাতনিকে- কোথায় কখন আবার বিপদে পড়ে অবুঝ মেয়েটা। খলবল করে কথা বলে আলেয়া, চঞ্চলা হরিণীর মতন ছুটে বেড়ায় মেঠো পথ ধরে।

এদিকে আলেয়ার মামার বিয়ে নিয়ে পাড়াপড়শীর ঘুম হারাম। আলেয়ার নানীকে এটা সেটা বুঝায় সবাই। আলেয়ার মামার এক কথা- ভাগ্নির বিয়ে না দিয়ে কোনমতেই বিয়ে করবে না সে। আলেয়ার নানী অনেক করে বোঝায় ছেলেকে। শেষমেশ মায়ের কথায় বিয়েতে রাজি হলো আলেয়ার মামা রহিম মিয়া। মেম্বারের বোন মর্জিনার সাথে বিয়ে হয়ে গেল রহিম মিয়ার। কি কপাল আলেয়ার- মামার বিয়ের পরপরই জন্ডিসে মারা গেল নানী।

নতুন মামীকে আলেয়া যতটাই আপন করে নিলো- ঠিক ততোটাই মামী যেন ওকে পর করে দিলো। বাসন ধোয়া, রান্না করা, ঘর ধোর সাফ করতে করতে আলেয়ার সোনার অঙ্গের দুধে আলতা রঙ মলিন হতে থাকে। তারমধ্যে নতুন উপদ্রুব মামীর ভাইয়ের ছেলে জব্বার। চিপা চিপা তালি মারা জিন্সের প্যান্ট আর উদ্ভট মার্কা পেট উদাম করা শার্ট পরে আলেয়ার সাথে ভাব জমাতে আসে। যখন তখন আলেয়ার গায়ে হাত দিতে তার এতোটুকু কুন্ঠাবোধ নেই। কুঁকড়ে থাকে আলেয়া। মামীও নানান ছুতোয় বারবার আলেয়াকে জব্বারের কাছে পাঠায়। সারাদিন ঘরে থাকেনা রহিম মিয়া, যার কারণে বুঝতে পারেনা অনেক কিছুই। কিন্তু ভাগ্নিটার দিকে নজর পড়লেই বুকটা তার হু হু করে ওঠে। ফুলের মতন মেয়েটা কেমন মন মরা হয়ে থাকে সারাদিন।

মর্জিনা উঠে পড়ে লেগেছে- জব্বারের সাথে আলেয়ার বিয়ে দেবার জন্য। গ্রামের সবাই জানে- লম্পট জব্বার কদিন আগেই ধর্ষণ মামলায় জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। পাঁচ বছর জেল খেটে বেরুনো ছেলের কাছে কে মেয়ে বিয়ে দেবে? তাইতো মর্জিনা টাকার লোভে ভাগ্নিকে তুলে দিতে চায় জব্বারের হাতে

মর্জিনা উঠে পড়ে লেগেছে- জব্বারের সাথে আলেয়ার বিয়ে দেবার জন্য। গ্রামের সবাই জানে- লম্পট জব্বার কদিন আগেই ধর্ষণ মামলায় জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। পাঁচ বছর জেল খেটে বেরুনো ছেলের কাছে কে মেয়ে বিয়ে দেবে? তাইতো মর্জিনা টাকার লোভে ভাগ্নিকে তুলে দিতে চায় জব্বারের হাতে।

যেদিন প্রথম রহিম মিয়ার কানে বিয়ের কথা তোলে মর্জিনা- তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে রহিম মিয়া। ওরকম এক লম্পটের হাতে কোনরকমেই ভাগ্নিকে তুলে দেবেনা রহিম। তাইতো  চুপিচুপি রেশমির সাথে ঢাকার লঞ্চে তুলে দেয় আলেয়াকে। আলেয়া খুব কেঁদেছে মামাকে জড়িয়ে ধরে। রহিম মিয়া এক হাজার টাকা গুঁজে দেয় ভাগ্নির হাতে। কেঁদে কেঁদে বলতে থাকে- তোর এই অধম মামারে মাফ কইরা দিস মা।

রেশমী চুড়ির কারখানায় কাজ জোগাড় করে দেয় আলেয়ার। প্রথম প্রথম সপ্তাহে সাতশো টাকায় কাজ করে আলেয়া। খুব দ্রুত কাজ শিখে নেয় আলেয়া। এখন মাইনে ডাবল হয়েছে। সপ্তাহে পনেরশো করে পায়। অর্ধেক চলে যায় রেশমির সাথে খাবার, আর ঘর ভাড়া শেয়ার করে। তাও বেশ যাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে রেশমির বরের নানান ছুতোয় আলেয়ার শরীর হাতড়ে বেড়ানো- দম বন্ধ করে মেনে নেয় আলেয়া। শুধু আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে বলে ঘুণাক্ষরেও জানতে দেয়না রেশমিকে। মনে মনে ভাবে- দেখেশুনে ভালো একটা ছেলেকে বিয়ে করে একদিন ঠিক চলে যাবে রেশমির কাছ থেকে। তখন তো আর রেশমির বর উৎপাত করতে পারবেনা।

নির্ঘুম আলেয়া বোরখা পরে পরেরদিন কারখানায় এলো। সহকারী ম্যানেজার তো দেখে অবাক

-কি ঘটনা আলেয়া, তুমি যে বোরখা পরছো? কেউ লাগছে বুঝি তোমার পেছনে?

কোন কথা বলেনা আলেয়া। সোজা চলে যায় ভেতরে। উসখুস করতে থাকে সহকারী ম্যানেজার কুদ্দুস। আলেয়াকে যে ওর ভীষণ ভালো লাগে। কিন্তু কোনোমতেই মেয়েটাকে বাগে আনতে পারছে না কুদ্দুস। কত মেয়ে এলো গেলো এই কারখানায়- আলেয়া অন্যরকম একটা মেয়ে। পরীর মতন সুন্দর, নরম মাখনের মতন দেখতে একটা শরীর। কুদ্দুসের ইচ্ছে করে বুকের মধ্যে চেপে ধরে মেয়েটাকে। খালি পারেনা নিজের একটা বউ আছে- যদি মালিক জানতে পারে চাকুরিটাই চলে যাবে। সারাদিন এতগুলো মেয়ের মধ্যে কাজ করে শরীরটা কেমন চনমন করে কুদ্দুসের। দুটো বাচ্চা হওয়ার পর ওর বউটা একটা হাতির মতন দেখতে হয়েছে। দেখলে কুদ্দুসের গা জ্বালা করে ওঠে। আর এই আলেয়া- তুলতুলে নরম আধফোটা ফুল।

দুপুরে খাবারের সময় ভেতর থেকে আলেয়াকে ডেকে আনে কুদ্দুস। মাঝখানে কাজের ফাঁকে দেখেছে আলেয়া কেমন আনমনা হয়ে আছে।

-সকালে তো কইলানা, কি হইছে তোমার? আমারে কও, দেহি কোন সমাধান করন যায় কিনা! উদগ্রীব হয়ে জানতে চায় কুদ্দুস।

চুপ করে থাকে আলেয়া কিছুটা সময়। বলা ঠিক হবে কিনা- নিজেই বুঝতে পারেনা। তারপর আস্তে আস্তে মুখ খোলে

-বড় বিপদে পড়ছি, কি করমু বুঝতে পারতাছি না। গ্রাম থেইক্যা আইস্যা পড়ছি যার কারণে হেয় অহন ঢাকায়!

-কি কও? তোমারে খুইজ্যা পাইছে? ব্যাকুল কণ্ঠ কুদ্দুসের

-হ, হেয় জানে আমি কই থাহি।

-কারখানা চিনছে হ্যায়? এই জায়গায় আইবো তোমারে খুঁজতে? আরে ওতো ডরাও ক্যান? আমরা আছিনা! পিডায়া হের চামড়া খুইল্যা হালামু। হেঃ হেঃ করে বীরোচিত হাসি হাসে কুদ্দুস।

রাতে আসমার ঘরে আশ্রয় নেয় আলেয়া। আসমা সাদরে গ্রহণ করে আলেয়াকে। বিপদে একটা মেয়ের পাশে আরেকটা মেয়ে না দাঁড়ালে- কে দাঁড়াবে? কিন্তু আসমার ঘরটা এতোই ছোট একটা চৌকি রাখার পর আর কোন জায়গাই নেই ঘরের মধ্যে। চৌকির নিচে হারিপাতিল, ট্রাঙ্ক, চালের বস্তা আরো কত কি দিয়ে বোঝাই করে রাখা। তারউপর আসমার একটা ননদ থাকে ওদের সাথে। চৌকিতে বসেই ওরা খায়, ঘুমায়, গল্পগুজব করে। আসমার স্বামী জুতার কারখানায় কাজ করে। কেমন করে যেন তাকায় লোকটা। আলেয়াকে দেখেই অনেক্ষন তাকিয়ে থাকে। আলেয়ার বুকটা কেঁপে ওঠে ওর চাউনিতে। রাতে তেমন কিছুই খেলোনা আলেয়া।  চৌকির উপর আসমা ওর স্বামী, বাচ্চা আর ননদকে নিয়ে শুয়ে পড়ে। ফ্লোরে যেটুকু জায়গা বাকি আছে- আলেয়া কোনরকমে চিকন হয়ে শুয়ে পড়ে।

দুশ্চিন্তায় চোখের পাতা এক হয়না আলেয়ার। কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে- ভেবে ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়ে। হঠাৎ মনে হলো কেউ একজন ওর গা ঘেষে শুয়ে পড়েছে। দুটো রোমশ হাত ছটফট করছে ওর শরীরের ভেতর। বুঝতে দেরী হয়না আলেয়ার। আসমার স্বামী এরই মধ্যে চৌকি থেকে নেমে এসেছে ওর পাশে। দুটো হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরেছে আলেয়াকে বুকের মধ্যে। তপ্ত ঠোঁট দুটো চেপে ধরেছে আলেয়ার ঠোঁটে। এতো ছোট জায়গায় আলেয়ার যেখানে নিজের কষ্ট হচ্ছে সেখানে আরো একটা মানুষ! আলেয়ার দমবন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। হাত দিয়ে যতই সরাতে চাইছে ততই ওকে বুকের মধ্যে শক্ত করে ধরছে আসমার স্বামী। মরিয়া হয়ে গো গো শব্দ করতে থাকে আলেয়া। ডান হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে মানুষটা।

কেঁদে ওঠে আসমার বাচ্চাটা। ঘুম ভেঙে যায় আসমার। মুক্তি পায় আলেয়া। কখন যেন বিছানায় উঠে গেছে আসমার স্বামী। বালিশ জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে চলে আলেয়া। এখানে আর থাকা যাবেনা, নতুন আশ্রয় খুঁজতে হবে আলেয়াকে। মনে মনে ঠিক করে কুদ্দুসকেই বলবে সমস্যার কথা।

পরেরদিন কারখানার সামনে যেয়ে হতভম্ব হয়ে যায় আলেয়া ।জব্বার দাঁড়িয়ে আছে গেটে। যেই আলেয়া ঢুকতে যাবে অমনি জব্বার ওর বোরখা হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেলে। আলেয়া চিৎকার করে উঠে আসমাকে জড়িয়ে ধরে। ভেতর থেকে দারোয়ান আর কুদ্দুস ছুটে আসে

-কে আপনে? কারখানার মেয়েগো বিরক্ত করতাছেন? কুদ্দুস হুঙ্কার দিয়ে ওঠে।

একহাতে আড়াল করে রাখে আসমা আর আলেয়াকে। অন্য হাতে কলার চেপে ধরে জব্বারের। দারোয়ানও ধরে রাখে জব্বারকে।

-হের লগে আমার বিয়ার কতা অইছে। পলায়া আইস্যা পড়ছে ঢাকায়। হের মামী অনেক টাকা খাইছে আমার থোন। এহন টাকা দেওনের নাম গন্ধ নাই। হেরে আমি লইয়া যাইতে  আইছি। রাগে গর্জাতে থাকে জব্বার।

-ওই মিয়া, মগের মুল্লুক পাইছোনি? মনে কইলো তুমি একজনরে তুইল্যা নিবা? দেশে কি আইন কানুন নাই? কুদ্দুস জব্বারের কলার ঝাকাতে ঝাকাতে বলতে থাকে।

-রাহেন মিয়া আমনের আইন কানুন! হেরে আমি নিমুই নিমু।

শুরু হয় প্রচন্ড দস্তাদস্তি। কয়েকটা কিল থাপ্পড় দিয়ে সেদিনের মতন জব্বারকে বিদায় করে দারোয়ান আর কুদ্দুস। কুদ্দুসের এই বীরোচিত কাজে কৃতজ্ঞতার ভাষা খুঁজে পায়না আলেয়া।

এমন দুর্দিনে আলেয়া যেন আলো খুঁজে পায়। কুদ্দুসকে মনে হয় পরম বন্ধু। হোক কুদ্দুস বিবাহিত, তবুও তো আলেয়ার জন্য বিরাট এক আশ্রয়। নিজের একটা ঘর হবে আলেয়ার, বন্ধুর মতন কুদ্দুস ওকে আগলে রাখবে সব বিপদ থেকে। কিন্তু প্রথম বউ আর বাচ্চাদের কি হবে?

সেদিন সন্ধ্যার আগেই কারখানা ছুটি হয়ে যায়। কুদ্দুস আগেই আলেয়াকে বলে রেখেছে ছুটির পরে কথা বলে যাবার জন্য। আসলে আলেয়াও চাইছিলো কুদ্দুস যেন ওকে রেশমির বাসায় পৌঁছে দেয়। সবাই চলে গেলে কুদ্দুস একটা রিকশা নিয়ে আলেয়াকে সোজা বেড়িবাঁধে নিয়ে আসে। বেড়ি বাঁধের উপর দিয়ে চলছে রিকশা। আলেয়া জড়সড় হয়ে বসে থাকে কুদ্দুসের পাশে। সিকদার মেডিকেল কলেজের কাছে এসে রিকশা ছেড়ে দেয় কুদ্দুস। জায়গাটা ভারী সুন্দর। অনেক ধরনের গাছ গাছালিতে ভর্তি হাসপাতালের ক্যাম্পাস। নিরিবিলি কথা বলার জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হয়না। দুজনে মিলে হাসপাতালের পেছনের পুকুর পাড়ে গিয়ে বসে। নানান জাতের ফুলে ছেয়ে আছে আশপাশ। দক্ষিণা ঠান্ডা বাতাসে মন ভরে যায়। ফেরার পথে আর বোরখা পরেনি আলেয়া। সকালের টানা হ্যাচড়ায় বোরখার উপরের অংশটা ছিড়ে ঝুলে পড়েছে বিশ্রী ভাবে।

ওড়নার আঁচল তর্জনীতে প্যাঁচাতে থাকে আলেয়া।

-কি ঠিক করছো? আইজ রাইতে কই থাকবা? প্রথমেই কথা বলে ওঠে কুদ্দুস। একহাতে জড়িয়ে ধরে রাখে আলেয়াকে।

-কিছুই বুঝতে পারতাছি না। আসমার বাসায় যাওন যাইবো না। রোকেয়ারে বলছিলাম- ওরা তিনজন একজনের রান্না ঘরে রাইতে ঘুমায়। এতো ছোড রান্না ঘর, আমার জায়গা হইবোনা। আর তো কেউরে চিনিনা আমি। রেশমী বুর কাছেই ফিরা যাওন লাগবো। যদি নিজের একখান ঘর থাকতো, তয় কি আর এতো ভাবন লাগতো? কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে আলেয়া।

-আমারে বিয়া করবা? আমি তোমার সব দায়িত্ব নিমু। হুট করেই বলে ফেলে কুদ্দুস। যেন বহুকাল ধরে এই কথাটা জমে ছিলো ওর বুকের ভেতর। বিস্ময়ে হতবাক আলেয়া তাকিয়ে থাকে কুদ্দুসের দিকে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে ওঠে

-আমনের বউ আছে, বাচ্চা আছে- আমনের কি মাথাডা খারাপ হইয়া গ্যাছে?

-মন দিয়া হোন আলেয়া, মুসলমান পুরুষ চাইরখান বিয়া করতে পারে। আর খাওয়ামু আমি, আমার বউর কি সমস্যা? তোমার এমন বিপদে আমি যদি পাশে না খারাই তাইলে ক্যামনে অয়? তোমার একটা আশ্রয় দরকার আলেয়া। হেইড্যা আমি দিমু তোমারে।

এমন দুর্দিনে আলেয়া যেন আলো খুঁজে পায়। কুদ্দুসকে মনে হয় পরম বন্ধু। হোক কুদ্দুস বিবাহিত, তবুও তো আলেয়ার জন্য বিরাট এক আশ্রয়। নিজের একটা ঘর হবে আলেয়ার, বন্ধুর মতন কুদ্দুস ওকে আগলে রাখবে সব বিপদ থেকে। কিন্তু প্রথম বউ আর বাচ্চাদের কি হবে?

-আমনের আগের বউ আর বাচ্চাগো কি অইবো? উদগ্রীব হয়ে জানতে চায় আলেয়া।

-হ্যারাও থাকবো। তুমিতো আর হ্যাগো লগে থাকবা না। এইহানে তোমারে রাহুম আমি। হাজারীবাগের বাসায় হ্যাগোরে খরচপাতি দিমু চলনের লাইগ্যা। অবলীলায় বলে চলে কুদ্দুস।

কুদ্দুসের সাথে বিয়ের কথা শুনে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে রেশমির। যাচ্ছে তাই বলে গালি দেয় আলেয়াকে। একটা বিবাহিত পুরুষকে কোন আক্কেলে আলেয়া বিয়ে করতে চাইছে- মাথায় ধরেনা রেশমির। শেষ পর্যন্ত আলেয়ার কথায় সম্মত হয় রেশমি। আলেয়া খুব সুন্দর করে রেশমিকে বোঝায়- পৃথিবীর সব পুরুষই এক, বিয়ের আগে যেটুকু ভালো থাকে বিয়ের পর সবাই একই রকম হয়ে যায়। তাছাড়া ওর একটা আশ্রয় দরকার, কতদিন আর রেশমির মাথার বোঝা হয়ে থাকবে! শেষে যদি জব্বার রেশমির সন্তানদের কোন ক্ষতি করে দেয়!

কুদ্দুসের সাথে পরেরদিনই বিয়ে হয়ে যায় আলেয়ার। কিন্তু কুদ্দুস শর্ত দেয় এই বিয়ের কথা কারখানার কেউ যেন না জানে। রেশমি আর তার জামাই এবং কুদ্দুসের দুই বন্ধুই শুধু জানবে এই বিয়ের খবর। দুজনেই আগের মতন কাজ করবে কারখানায়।

আলেয়াকে কুদ্দুস লাল একটা টাঙ্গাইলের শাড়ী কিনে দিয়েছে। ইফতারির পরে সেই শাড়ি পরে আলেয়া রেশমির সাথে লালবাগ কাজী অফিসে আসে। সাথে রেশমির বরও আসে। অন্যদিকে কুদ্দুস সাদা রঙের পাঞ্জাবিপাজামা আর টুপি মাথায় দিয়ে আসে দুইজন বন্ধুকে সাথে করে। আগের বিয়ের কথা গোপন করে পঞ্চাশ হাজার টাকা অনাদায়ী দেনমোহর ধার্য করে বিয়ে হয়ে গেল কুদ্দুস আর আলেয়ার। মিষ্টি মুখ করে পরেরদিন নতুন বাসায় উঠবে ঠিক করে যে যার বাসায় ফিরে গেল বিয়ের পরে। আলেয়া চলে এলো রেশমির বাসায়। একটা রাত পরেই শুরু হবে ওর নতুন জীবন।

যথারীতি কারখানায় এলো দুজনেই আগের মতন। কিন্তু কুদ্দুসকে দেখে আলেয়ার মনটা কেমন যেন এক আনন্দে ভরে ওঠে। সন্ধ্যার পরে আজই ওরা নতুন বাসায় উঠবে। নিজের একটা ঘর, ছোট্ট সংসার- কেমন এক শিহরণ বয়ে যায় আলেয়ার ভেতর। আগেই বলা আছে- কুদ্দুস গলির মোড়ে ওর জন্য অপেক্ষা করবে। তারপর রেশমির বাসা থেকে আলেয়া ব্যাগ নিয়ে এসে মিলিত হবে কুদ্দুসের সাথে।

লালবাগ কিল্লার পাশ দিয়ে চিপা একটা গলিতে ঢোকে রিকশা। সামনে এতটাই সংকীর্ণ পথ রিকশা আর যেতে পারেনা। রিকশা থেকে নেমে পায়ে হেটে এগোয় দুজনে। কোথাও কোথাও ড্রেন উপচে রাস্তা থৈ থৈ করছে নোংরা জলে। কোথাও আবার ম্যানহোল উপচে মানুষের বর্জ্যে থকথকে হয়ে আছে রাস্তা। এক বাড়ির সাথে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আরেক বাড়ি। অবশেষে ভাঙা জড়সড় একতলা একটা বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকলো কুদ্দুস আর আলেয়া। টিমটিমে একটা লাইট জ্বলছে পুরনো, জরাজীর্ণ বাড়িটার বারান্দায়। অল্প আলোয় কেমন ভুতুড়ে লাগছে বাড়িটাকে।

ভাঙা কাঠের দরজায় টোকা দিতেই বাড়ির কেয়ার টেকার এসে দরজা খুলে দেয়। কুদ্দুসকে দেখে একগাল হাসে ছেলেটা। বোঝা যায় আগের পরিচিত। একটু ঝুকে ভেতরে তাকায় আলেয়া। চৌকিতে দুটো বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে আর একটা মহিলা বিছানায় বসে ভাত খাচ্ছে। আলেয়া বুঝতে পারে হয়তো এই লোকটার বউ হবে ওই মহিলা। কেয়ার টেকার চাবি নিয়ে একটা টর্চ হাতে করে ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে ছাদে। এবড়ো থেবড়ো, ভাঙা চোরা সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে আসে আলেয়া আর কুদ্দুস। কেমন যেন ভয় ভয় লাগে আলেয়ার। এতো পুরনো বাড়ি, এরা ভেঙে কেন নতুন বাড়ি বানায় না? আলেয়ার মনের কথা যেন টের পায় কেয়ারটেকার। নিজে নিজেই বলতে থাকে

-মালিক বহু বছর আমেরিকায় থাকে। আসি আসি কইরাও আসেনা। আমারে থাকতে দিছে, দেহাশুনা করি এই আরকি! বেইচা ফালাইতে কই হেও বেঁচেনা। বড় লোকের জমি- পইরা আছে! এতো গিঞ্জি জায়গা- ডেভেলপারাও নিতে চায়না।

ছাদের উপরে চিলেকোঠার ঘর। প্লাস্টার খসে পড়ছে ওয়ালের। ছোট্ট ঘরটার একপাশে একটা জানালা, উপরে  টিনের চাল। ঘরের এক কোনায় একটা চৌকি রাখা। চৌকির উপর তোষক চাদর বিছানো। দুটো বালিশ রাখা। কুদ্দুস দিনে এসে তোষক বালিশ কিনে গুছিয়ে রেখে গেছে। ষাট পাওয়ারের একটা বাল্ব ঝুলছে মাথার উপর। হাতের ব্যাগ আর টুকিটাকি জিনিস নিচে রেখে বিছানায় বসে পড়ে  আলেয়া। কেয়ারটেকার চলে গেলে খোলা ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়। এক কোণায় একটা লাইট জ্বলছে। সেখানেই নিচে একটা রান্নার চুলা। পাশে পানির ট্যাংকির সাথে একটা কল লাগানো ধোয়া মোছা আর গোসল করার জন্যে। কেয়ারটেকার উপরে ওঠার সময় দেখিয়ে দিয়েছে সিঁড়ির নিচেই টয়লেটের ব্যবস্থা।

ছাদে এসে মনটা ভালো হয়ে যায় আলেয়ার। ঢাকার শহরে এমন খোলা ছাদ চিন্তাই করা যায়না। যদিও আশেপাশের বাড়িগুলো এতোটাই উঁচু উঁচু যে এই একতলা বাড়িটা থেকে উপরের আকাশ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়না। তবুও আকাশ যে দেখা যায়- এই অনেক! মনে মনে ভাবে আলেয়া। আলেয়াকে ঘরে রেখে কুদ্দুস বেরিয়ে যায় বাইরে। এতোক্ষন সময় আলেয়া নিজের ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করে। আয়না বের করে নিজের অবয়ব দেখে। কেমন এক খুশির বন্যা বয়ে যায় আলেয়ার অবয়ব জুড়ে। নিজের মতন করে থাকবে- হোক ভাঙা চোরা ঘর! তবুও নিজের, একান্ত আপনার। ঠোঁটে ঘষে ঘষে লিপিষ্টিক লাগায়। চিরুনি দিয়ে পরিপাটি করে চুল আচড়ায়। তারপর একটা বেনী করে পিঠে ঝুলিয়ে রাখে।

আবার কুটকুট কামড়াতে থাকে ছারপোকা। অসহ্য কামড়ে বিছানায় উঠে বসে আলেয়া। ব্যথাতুর শরীর নিয়ে লাইট অন করে খুঁজতে থাকে ছারপোকা। নাহ্! একটাও পায়না খুঁজে। আবার লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। যেই শোয় অমনি কামড়াতে লাগলো ছারপোকা। শেষে উঠে বসে আলেয়া। দরজা খুলে বিছানা, চাদর, বালিশ, সংসারের সব কিছু ছাদে এনে জড়ো করে। চুলার পাশ থেকে লাইটার নিয়ে এসে চাদরের এক কোনায় আগুন ধরিয়ে দেয়

দুই প্যাকেট বিরিয়ানী আর পানির বোতল নিয়ে ফেরে কুদ্দুস। বিছানার এক কোণায় রাখে

-ঘর পছন্দ হইছে গো বউ? কাইল হাড়িপাতিল কিনুম, বাজার করুম। তুমি নিজের হাতে কাইল রানবা। বলতে বলতে আলেয়াকে জড়িয়ে ধরে কুদ্দুস। পকেট থেকে ছোট্ট একটা লাল গহনার প্যাকেট বের করে আলেয়ার হাতে দেয় কুদ্দুস।

কি এইডা? বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটেনা আলেয়ার।

খুইল্যা দেহো! রহস্য ময় হাসি দেয় কুদ্দুস।

নাকফুল! প্যাকেট খুলে আনন্দে জ্বলমল করে আলেয়ার চোখ দুটো।

কুদ্দুসের বুকে পরম সুখে মাথা রাখে আলেয়া। আর কোন চিন্তা নাই- নিজের একটা স্বামী আছে, ঘর আছে আলেয়ার। অন্য কোন পুরুষ আর যন্ত্রণা দিতে সাহস পাবেনা।

ঈদের পরে বেশ কিছুদিন কারখানা বন্ধ থাকে। কুদ্দুস মাঝে মাঝে আগের বউ বাচ্চার কাছে যায়, কোনদিন দিনে কোনদিন রাতে। খুব গুছিয়ে সংসার করে আলেয়া। সুখের প্লাবনে ভেসে যায় আলেয়ার জীবন। শুধু রাতে বিছানায় শুলে পরে আবার সেই ছারপোকার কামড়। নতুন বিছানা বালিশে কি করে ছারপোকা হলো ভেবে পায়না আলেয়া। পরে বুঝতে পারে নিজের কাপড় চোপড়ের সাথেই রেশমির ঘর থেকে ছারপোকা এসে আস্তানা গেড়েছে ওর ঘরে। ছাদে নিয়ে রৌদ্রে দিয়ে বিছানা বালিশ ঝেড়ে পরিষ্কার করে আনে। দুদিন পর আবার সেই পুরনো উৎপাত। কুটকুট করে কামড়ায় সারা রাত। একমাস পরে আবার কারখানা চালু হয়। সামনেই কোরবানির ঈদ, দুর্গা পূজা। পুরো উদ্যোমে কাজ শুরু হয় কারখানায়।

একদিন সন্ধ্যায় আলেয়ার কোলে মাথা রেখে খুনসুটি করছে কুদ্দুস। আলেয়া কুদ্দুসের চুল টেনে দিচ্ছে কোমল আঙুলের স্পর্শে। এই একমাসে সংসারে অনেক কিছু করেছে আলেয়া। একটা আলনা কিনেছে, ছোট্ট একটা কাঠের টেবিল কিনেছে সাথে প্লাস্টিকের দুটো মোড়া। ঈদের বোনাসের টাকা দিয়ে একটা স্টিলের তাক কিনেছে। নিজের সংসার দেখে নিজেরই কেমন চোখ জুড়িয়ে যায়। কুদ্দুসের আদর সোহাগে শরীরটাও কেমন সোহাগী হয়ে ওঠেছে আলেয়ার।

হঠাৎ বাইরে কেমন ধুমধাম শব্দে আঁতকে ওঠে আলেয়া। লাফ দিয়ে চৌকি থেকে নেমে দরজা খোলে কুদ্দুস। হুড়মুড় করে ঘরে ঢোকে মোটা এক মহিলা- সাথে আরো দুজন পুরুষ লোক। এদের দেখেই ভড়কে যায় কুদ্দুস। মহিলা চিৎকার করে বলতে থাকে-

-নাইট ডিউটি করছ? এই তোর নাইট ডিউটি? হারামজাদা আইজ তোর একদিন কি আমার একদিন! বিয়া করছো? ছুটামু তোমার বিয়া? ওই হারামজাদী, কোন মায়ের মাইয়্যা তুই? বিয়া করণের এতো শখ? আর ব্যাডা পাইলি না হারামজাদী? বলতে বলতে আলেয়ার চুলের মুঠি ধরে পিঠের উপর এলোপাথাড়ি কিল মারতে লাগলো ওই মোটা মহিলা। মারের চোটে দিশেহারা হয়ে পড়ে আলেয়া। বুঝতে পারে এই মহিলা কুদ্দুসের আগের বউ, সাথে পুরুষ দুজন- একজন কুদ্দুসের বন্ধু আলেয়ার বিয়েতে উপস্থিত ছিলো আর অন্যজন কারখানার ম্যানেজার।

প্রচন্ড হৈ চৈ আর মারামারি করে কুদ্দুসকে নিয়ে চলে যায় সবাই। না গিয়ে কুদ্দুসের কোন উপায় ছিলোনা। কারখানার মালিকের কাজের মেয়ে বিয়ে করেছে কুদ্দুস- যার বিনিময়ে এই চাকুরী জুটেছে কুদ্দুসের। এ কান সে কান করে কদিন আগেই কুদ্দুস আর আলেয়ার বিয়ের খবর পৌঁছে যায় কুদ্দুসের প্রথম স্ত্রীর কাছে। কুদ্দুসের স্ত্রী নালিশ করে মালিকের কাছে। মালিক ম্যানেজারকে হুকুম দেয় কুদ্দুসকে ধরে নিতে।

ম্যানেজার হাবিব আলেয়া হাত থেকে ছুটে যাওয়ায় বিগড়ে যায় মনে মনে। সুযোগের অপেক্ষায় থাকে কি করে আলেয়ার উপর প্রতিশোধ নেবে। কুদ্দুস আলেয়াকে পেয়ে গেছে ভাবলেই হিংসায় জ্বলে ওঠে ওর শরীর। তাইতো মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগাতে ছুটে আসে কুদ্দুসের বউকে সহযোগিতা করতে। কুদ্দুসের প্রথম বউয়ের সাথে সেও দু’ এক ঘা লাগায় আলেয়া আর কুদ্দুসের শরীরে।

এলোমেলো ঘরের মেঝেতে নিঃসঙ্গ পড়ে থাকে আলেয়া। বিশাল এক ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে ওর সাজানো সংসার। নিচতলার বউটা এসে কিছু জিনিস গুছিয়ে দিয়ে চলে যায়। মাঝরাতে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে আলেয়া। রান্না করা ভাত, মুরগির মাংস পড়ে থাকে সেলফে- ছুঁয়েও দেখেনা আলেয়া। চোখে মুখে অন্ধকার দেখতে পায়। স্বামী গেল, চাকুরীটা গেল- কি হবে এখন আলেয়ার? কোথায় যাবে? চোখের পানিও যেন শুকিয়ে গেছে। সারা শরীর ব্যথায় টনটন করছে। ম্যানেজার পাকাপোক্ত ভাবেই নিয়ে গেছে কুদ্দুসকে। খালি স্টাম্পে আলেয়ার সই নিয়ে গেছে। একা, অসহায় আলেয়া কিচ্ছু করতে পারলোনা। খালি পরে পরে মার  খেয়েছে ওই দজ্জাল মহিলার।

আবার কুটকুট কামড়াতে থাকে ছারপোকা। অসহ্য কামড়ে বিছানায় উঠে বসে আলেয়া। ব্যথাতুর শরীর নিয়ে লাইট অন করে খুঁজতে থাকে ছারপোকা। নাহ্! একটাও পায়না খুঁজে। আবার লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। যেই শোয় অমনি কামড়াতে লাগলো ছারপোকা। শেষে উঠে বসে আলেয়া। দরজা খুলে বিছানা, চাদর, বালিশ, সংসারের সব কিছু ছাদে এনে জড়ো করে। চুলার পাশ থেকে লাইটার নিয়ে এসে চাদরের এক কোনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। আস্তে আস্তে আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে সব কিছুতে। পুড়তে থাকে বিছানা বালিশ, আলেয়ার সংসার। সেইসাথে পুড়তে থাকে ছারপোকার দল। ছাদের উপর দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। রাতের অন্ধকার ভেদ করে সেই আগুনের রশ্মি দেখা যায় অনেক দূর থেকে। ফজরের আজানের সাথে দূর থেকে ভেসে আসে কয়েকটি উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর -আগুন… … আগুন! ভাঙা পাঁচিল টপকে রাস্তায় নেমে আসে আলেয়া।

আরো পড়তে পারেন

প্রতিদান

‘আমাকে আপনার মনে নেই। থাকার কথাও নয়। সে জন্য দোষও দেব না। এত ব্যস্ত মানুষ আপনি, আমার মত কত জনের সঙ্গেই হঠাৎ চেনা-জানা। কেনইবা মনে রাখবেন তাদের সবাইকে?’ বেশ শান্ত গলায় বললেন মিসেস অঙ্কিতা। টেবিল থেকে কি যেন একটা নিলেন তিনি। পিটপিট করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সাফরাব। একটা ইনজেকশন, একটা ছোট টেস্টটিউবের মতো ভায়াল,….

লিলিথ

শাওয়ার বন্ধ করে দিতেই পানির হালকা ঝিরঝিরে শব্দটা বন্ধ হয়ে যায়। প্রযুক্তির কল্যাণে ঝরনার শব্দ আজকাল বাসাতেই শোনা যাচ্ছে। আর এ শব্দটা অদ্ভুত সুন্দর। কেমন যেন মোলায়েম। সাদা তুলতুলে মেঘের মতো। অনেক দূর থেকে ভেসে ভেসে এসে জড়িয়ে ধরে। চোখের পাতাগুলোয় ঠান্ডা আমেজ ছড়িয়ে ঘাড় বেয়ে নামতে থাকে। আরামে চোখ বুজে আসে আমার। রিলাক্স হতে….

বন্ধনবিলাস

এ শতকের ধূলিধূসরিত ঢাকায় দাঁড়িয়ে কল্পনা করাও কঠিন। গত শতকের ঢাকা ছিল রাজহাঁসের পালকের মতো পরিচ্ছন্ন ধবধবে। একতলা-দোতলার ছাদে শীতলপাটি বিছিয়ে রাতের আকাশের দিকে চাইলে দেখা যেত নক্ষত্রদের কনফারেন্স। মেঘহীন রাতগুলোতে খুব কাছের হয়ে যেত দূরছায়া নীহারিকার পথ। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। অগণ্য তারার যে কোনো তারাকে। রাস্তার দু’ধারে জামরুল-জিউল আর বাবলার অন্ধকার ঢাকতে….

error: Content is protected !!