Author Picture

আড্ডা প্রাত্যহিক জীবনেরই অনুষঙ্গ

সৃজন আড্ডার লেখকরা একটি বিষয় নির্বাচন করে নেন এবং নির্দিষ্ট সদস্যদের বলা থাকে সেই বিষয়েই মূল বক্তব্য দেয়ার জন্য। অন্যান্য বিষয়ের মুক্ত আলোচনাও থাকে, তবে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় পূর্বে নির্ধারিত বিষয়ের উপরে। সৃজন সাহিত্য গোষ্টির এবারের আড্ডার বিষয় ছিলো, সাহিত্যে সমকালীনতা। সমকালীন বিষয় এবং ঘটনা প্রবাহ সাহিত্যে কতটুকু প্রাধান্য পায় এবং কতটুকু পাওয়া উচিত এ নিয়েই চলে তুমুল আড্ডা এবং তর্ক-বিতর্ক অন্য সাহিত্য আড্ডার সঙ্গে এর বিশেষ পার্থক্য, এরা আড্ডা শুরুর আগেই আড্ডার সদস্যদের জানিয়ে দেয় আড্ডায় কি নিয়ে আলোচনা হবে। যে কারনে এটি একই সঙ্গে সাহিত্য আড্ডা আবার পাঠচক্রও বলা যায়। সৃজন গোষ্ঠীর আড্ডায় উপস্থিত সবাই আড্ডারও স্বাদ পান আবার সাহিত্য বিষয়েও জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হন। সৃজন আড্ডার লেখকরা একটি বিষয় নির্বাচন করে নেন এবং নির্দিষ্ট সদস্যদের বলা থাকে সেই বিষয়েই মূল বক্তব্য দেয়ার জন্য। অন্যান্য বিষয়ের মুক্ত আলোচনাও থাকে, তবে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় পূর্বে নির্ধারিত বিষয়ের উপরে।
সৃজন সাহিত্য গোষ্টির এবারের আড্ডার বিষয় ছিলো, সাহিত্যে সমকালীনতা। সমকালীন বিষয় এবং ঘটনা প্রবাহ সাহিত্যে কতটুকু প্রাধান্য পায় এবং কতটুকু পাওয়া উচিত এ নিয়েই চলে তুমুল আড্ডা এবং তর্ক-বিতর্ক। তবে সুশৃঙ্খলভাবে লেখকরা পর্যায়ক্রমে সবাই সবার বক্তব্য দিয়েছেন নিয়ম মেনে। কারো কথার মধ্যে কেউ কথা বলেন নি। একজন বলেছেন অন্যরা তা শুনেছেন এবং বক্তাকে পাল্টা প্রশ্ন করার জন্য নোট রেখেছেন। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে ছিলো চা, কফি আর নানা রকমের খাবারের ব্যবস্থা এবং হাসির জোগান দেয়ার মতো নানা কৌতুক গল্প।

সাহিত্যে সমকালীন বিষয়ের উপস্থিতি প্রসঙ্গে জনপ্রিয় তরুণ রাজনীতিবিদ এবং কলামিস্ট ব্যারিস্টার মীর হেলাল বলেন- সাহিত্য সমাজের কথা বলে মূলত ইতিহাস-ঐতিহ্যের আশ্রয়ে। এটা সামগ্রীক সত্য। কিন্তু নিরেট বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাওয়াটা সাহিত্যের খারাপ সময় হিসেবে ইতিহাসে থেকে যায়। সাহিত্যিক একই সঙ্গে তার সময়ের একজন উজ্জ্বলতর সচেতন নাগরিক। সময়ের আর্থ-রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের প্রতিবাদ জানানোটাই হওয়া উচিৎ লেখকের মূল দায়িত্ব। কোনো অজুহাতেই এটাকে এড়িয়ে যাওয়া উচিৎ নয়। একটি লেখা লক্ষ জনতার প্রতিবাদের সমান হতে পারে। সেই যায়গা থেকে লেখককে ভাবতে হবে। সব পরিস্থিতিতে বাস্তবতাকে আমরা ইতিহাসের হাতে বিচারের জন্য রেখে দিতে পারি না।

কবি আদিত্য নজরুল বলেন- প্রকৃতি যেমন একজন সৃষ্টিশীল মানুষের কাছে উপভোগ্য, উপজীব্য তেমনি সময় কিংবা সমকাল নিবিড় ভাবে সম্পর্কিত। মানুষের আনন্দবেদনার বিচিত্র অনুভুতি নিয়েই সাহিত্যের অগ্রযাত্রা। সময়ের সাথে সাহিত্যের নিবিড় সম্পর্ক। এই প্রবাহমান সময়ের যেখানে এখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি তা হলো বর্তমান বা সমকাল। এই বর্তমান সময়ের সাহিত্য কর্মই হলো সমকালীন সাহিত্য। সমকালের জলে অবগাহন করে সৃষ্টিশীল প্রতিটি মানুষ (কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী) বিকশিত করেন তার সৃষ্টি। সমকাল যেমনি একজন লেখকের উপর প্রভাব বিস্তার করে তেমনি একজন লেখকও চান সমকালকে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে তুলে ধরতে। বলা যায় যে, যেই সময়ে জীবনের বিকাশ ঘটে তার প্রচ্ছন্ন প্রভাব সাহিত্যসৃষ্টিতে অবশ্যই পরিলক্ষিত হয়।
ভাষা যদি সাহিত্যে নৌকা হয় তাহলে নদীর বুকের বহমান স্রোত হলো সময় বা সমকাল। সময়ের গতি প্রকৃতির সাথে সাথে সৃষ্টিশীল মানুষের চিন্তাও বাঁক ফেরা নদীর মতো গতি পরিবর্তন করে। যে কোন কালজয়ী লেখার দিকে তাকালেই তার স্পষ্ট চিহ্ন আমরা দেখতে পাই। বুঝতে পারি লেখার সময় কিংবা বিকাশের ঘটনা প্রবাহ। সময়ের সাথে সাথে ভাষা ও বোধ এর রুপ বদল হয় কথাটি মানতেই হবে। প্রাচীন কালের ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে যেমন মধ্যযুগের ভাষার বিস্তর দূরুত্ব, তেমনি আজকের লেখার সঙ্গে ভবিষ্যতের লেখারও একটি পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে। এটা দোষের কিছু না বরং ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ। জীবনের বিচিত্র আচার আচরন তো সময়ের কাছ থেকেই আমরা প্রতিনিয়ত পাঠ করি। সমকালীন স্রোতে ভেসে ভেসে ভাষা ও সাহিত্য একদিন গৌরবময় স্থানে পৌঁছে যাবে এটা আমার বিশ্বাস। সাহিত্যের স্বরুপ অনুসন্ধান করতে হলে সমকালের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে প্রেমিকার নেশাতুর চোখের মতো।

কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট সাইফুর রহমান বলেন- সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে সাহিত্যে সমকালীনতার প্রয়োগ। অন্যভাবে এটাকে একজন সাহিত্যিকের অপরিহার্য দায়িত্ব বলা যেতে পারে। একজন লেখক যেহেতু সমাজেরই অংশ সেহেতু যে সব ঘটনা দ্বারা সমাজ আবর্তীত হয় সেগুলো সাধারণত কবি সাহিত্যিকদের মনে রেখাপাত করে, উদ্বেলিত করে। সেই প্রেরণা থেকেই একজন লেখক কিংবা কবির লেখার উপজীব্য হয়ে ওঠে- সমাজের সমসাময়িক বিষয়গুলো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান যখন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিলেন তখন সে প্রেক্ষাপটে শওকত ওসমান লিখেছিলেন উপন্যাস ‘ক্রীতদাসের হাসি’। ভাবতেও অবাক লাগে কি এক অনবদ্য সৃষ্টি তিনি রচিত করেছিলেন তার শানিত কলম দিয়ে। ঠিক তেমনি কবি হেলাল হাফিজ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লিখেছিলেন ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ কিংবা ১৯৪৬ সালের মনন্তরের প্রেক্ষাপটে বিভূতিভুষন বন্দোপাধ্যায় লিখেছিলেন উপন্যাস ‘অশনি সংকেত’। তবে অনেক সাহিত্যিক আবার এমন কিছু সৃষ্টি করেন যা সব সময়ই সমকালীন যেমন সত্যজিৎ রায়ের ‘হিরক রাজার দেশে’। এই বইটি যদি এখনও পাঠ করা যায় মনে হবে যেন আমারা হয়তো এখনো হিরক রাজার দেশেই বসবাস করছি।

কবি ও কথাসাহিত্যিক মানজুর মুহাম্মদ বলেন- সাহিত্যে সাহিত্যিকের সময়ের উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরী। এটা লেখকের নৈতিক সততারও ব্যাপার। প্রত্যেক লেখককেই তার সময়ের কাছ থেকে পাঠ নিতে হয়। সময় অনেক কিছু শেখায়। সময়কে এড়িয়ে যাওয়া মানে নিজেকেই এড়িয়ে যাওয়া। প্রকৃত সাহিত্যের সঙ্গে সময়ের ইতিহাসও লিখিত হয়ে থাকে। তাই একজন লেখকের উচিৎ নিজের সময়কে ধারন করা।
কবি ও সাংবাদিক জুননু রাইন বলেন- আমরা যে সময়টি যাপন করি, সে সময়টি একই সঙ্গে আমাদেরও বহন করে। সময়কে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুধু করা যায়, এড়ানো যায় না। উপরন্তু সেই চেষ্টাটি বিদ্রুপের রুপে দৃশ্যমান হয়। সময়কে এড়িয়ে যেতে চাইলে সময় লেখকের গায়ে সেই দোষে দোষীর চিহ্ন এঁকে দেয়। সে হিসেবে কোন প্রকৃত লেখকের পক্ষেই সময়কে এড়ানো সম্ভব নয়। লেখকের কাজই সময়কে পড়া, পড়ে এর নির্যাস পাঠকের জন্য তুলে ধরা।

কবি, কলামিস্ট ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. তৌফিক জোয়ার্দার বলেন- ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার সবটুকু খারাপ তা যেমন বলা যাবে না, একে নির্ভেজাল আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচনা করলেও সত্যের অপলাপ হবে। ব্রিটিশ আমলে ইংরেজি নির্ভর শিক্ষাক্রমে প্রাচীন ভারতীয় ও বাংলার আদি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা, যা হাজার বছর ধরে এ ভূখন্ডে বিরাজমান ছিল, ক্রমান্বয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বাধীনতার পরও আমাদের ইতিমধ্যে ভোঁতা হয়ে যাওয়া স্বজাত্যবোধের কারণে সেই প্রাচীন ঐতিহ্য সঞ্জাত শিক্ষার নির্যাস আমাদের শিক্ষাক্রমে বিশেষ স্থান করে নিতে পারেনি। উপরন্তু, ঔপনিবেশিক শিক্ষার সাথে যুক্ত হয়েছে নব্য পুঁজিবাদী ও বস্তুতান্ত্রিক উপসর্গসমূহ। যে শিক্ষায় অর্থ সমাগমের সম্ভাবনা নেই, সে শিক্ষার প্রয়োজন কী- এমন একটি মনোভাব যেন শিক্ষাক্রমের পরতে পরতে প্রচ্ছন্ন অবস্থান ঘোষণা করে চলেছে। এ কারণেই, কবিতা এবং এর ছন্দ, অলঙ্কার ও রসতত্বের আলোচনা বহু আগেই আমাদের শিক্ষাক্রম থেকে নিরবে তিরোহিত হয়েছে। আগে, কবিতা ও তার গঠননৈপুণ্য জানতে বা বুঝতে বাংলাসাহিত্য বা ভাষাতত্বের পন্ডিত হবার প্রয়োজন পড়তো না। মায়ের দুধে শিশুর যেমন সহজাত অধিকার, ভাষা ও সাহিত্যে- লিখতে পড়তে জানা মানুষ মাত্রেরই তেমন সহজাত অধিকার স্বীকৃত ছিল। তাই কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেক কবি সাহিত্যিককেই অত্যন্ত উন্নত ভাষাজ্ঞান ও ছন্দ-অলঙ্কার-রস তত্বে ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার দ্বারস্ত হতে হয়নি। প্রাথমিক বা বড়জোর মাধ্যমিক স্তরের গড়পড়তা শিক্ষাই কবি তার সহায়-সস্ত্র-হাতিয়ার যোগান দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু বর্তমান শিক্ষাক্রমের দিকে তাকালে- ওখানে কবি হয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় রসদগুলো কি আদৌ চোখে পড়ে? পড়ার কথা নয়, কারণ কবিতা লিখে নগদ অর্থযোগের অপার সম্ভাবনা কোথায়? কাজেই কবিতা এবং কাব্য আমাদের ভোগবাদী, উগ্রপুঁজিবাদীও বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থা থেকে স্বভাবতই নির্বাসিত। একারণে কবিতা সম্পর্কে মানুষের পার্সেপশন এখনো অন্তত শতাব্দীখানেক পিছিয়ে আছে। কবি বলতে এখনো মানুষ সেই অষ্টাদশ শতকে বাঙ্গালির পরিধেয় ঢোলা পোষাক, কাঁধে ঝোলানো চটের ব্যাগ, শ্মশ্র“মন্ডিত মুখমন্ডল- এমনই মেজারিং স্টেরিওটাইপের বাইরে যেতে পারেনি। দুঃখের বিষয়, কবিযশোপ্রার্থী অনেক যুবকও এই তথাকথিত ‘কবি কবি ভাব’ চর্চাকে বাস্তবিক কবিতার আঙ্গিকগত উৎকর্ষ চর্চার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে থাকে। কবিতায় তাই সময় এসে থমকে আছে সেই অষ্টাদশ কি বড়জোর ঊনবিংশ শতাব্দীতে। পাশ্চাত্য কবিতায় যেখানে স্থান করে নিচ্ছে ঋজুভাষা, সমসাময়িক রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি কূটনীতি, বাংলা কবিতা সে তুলনায় কোথায় আছে তা ভেবে এবং মেপে দেখার প্রয়োজন আছে। পাশ্চাত্য কবিতার বিষয়বস্তু যখন একটি পেট্রলপাম্প (Elizabeth Bishop এর The Filling Station), দড়িতে শুকাতে দেয়া কাপড় (Richard Wilbur এর Love Calls Us to the Things of the World), সমুদ্র সৈকতে পড়ে থাকা কাঁচ (Amy Clampitt এর Beach glass) ইত্যাদি, বাংলা কবিতায় এমন আধুনিক দিনানুদৈনিক অনুষঙ্গ কি স্থান করে নিতে পেরেছে?

কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট আব্দুল্লাহ ওমর সাইফ বলেন-
সমকালীন সাহিত্য চর্চা করতে গেলে আশেপাশে কী কী ঘটছে আর সেসব কেমন করে আমাদের চিন্তাভাবনায় প্রভাব ফেলছে- এটা বোঝা খুব জরুরী। হড়বড় করে একগাদা ঘটনার বিবরণ লিখে পাতা ভরালেই হয় না। ওসবের মনস্তত্বটাও পাঠকের পাতে তুলে দিতে জানতে হয়। তাছাড়া এ যুগটা তো আর তারাশংকর বা অদ্বৈতবাবুদের যুগের মতন নয়। ওনাদের সময় গ্লোবালাইজেশনের গতি ছিল অতি ধীর। পাঠকের কল্পনায় গ্যাসের বাতি রেলগাড়ি বা ডাকবাক্স দীর্ঘদিন ধরে ঐ একই দ্যোতনা সৃষ্টি করে এসেছে। কিন্তু এখনকার সমকালীনতা আগের মত এত রক্ষনশীল নেই। সমুদ্রতীর বলতে আজকাল কী আর শুধু রোমান্টিক কিছু চোখে ভাসে? নাকি সিরিয়ান বা রোহিঙ্গা শিশুদের থুবড়ে পড়া লাশের ছবির কথাও মনে হয়? তাই আমার বিশ্বাস একজন লেখকের উচিতই হবে না এসব বাদ দিয়ে শুধুমাত্র অতীতকে রোমান্টিসাইজ করে পড়ে থাকা। এই যুগে একজন সমকালীন লেখককে ঘটনার বিশ্লেষণ করতে হবে সবকিছু মাথায় রেখে দশদিকে চোখ খোলা রেখে। কাজটা অত সহজও নয়। ঘটনার যোগসূত্র বাদ দিয়ে সমকালীনতা হয় না। সমকালীনতার মধ্যে অতীতের সাক্ষ্য এবং একটা আধুনিক মনের চিন্তার সামঞ্জস্য থাকাটাও দারুন গুরুত্বর্পূর্ণ।

কবি শামস আরেফিন বলেন-
সাহিত্যে সমসাময়িকতাকে এড়িয়ে যাওয়া বা সমাজ ও সংস্কৃতিকে বিরাজনীতিকরণ করার অর্থই হচ্ছে শিল্প-সাহিত্য থেকে রাজনীতিকে আলাদা করা। দেশ ও সমাজের মানুষের প্রতিবিম্ব প্রতিফলন ঘটে সাহিত্য নামক আয়নায়। আর এ আয়নায় যদি সমাজের চাহিদা, মানুষের ভোগান্তি, শাসন-শোষণ নির্যাতন না তুলে ধরা যায়, তবে সাহিত্য আর সাহিত্য থাকে না। বরং হয়ে যায় তা নির্বিষ বিষয় বস্তু। ধরা যাক- কাজী নজরুল ইসলাম যদি মনে করতেন, তিনি শোষণবিরোধী লেখা লিখবেন না, তবে তার আর বিদ্রোহী কবিতা রচনা করা হত না। আর চিলির পাবলো নেরুদার বদল আমরা হয়তো পেতাম মেরুদন্ডহীন লাতিন আমেরিকার অন্য কোন এক কবিকে। অথচ পাবলো নেরুদা তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত চিলির স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তার জনপ্রিয়তা ভয়ে শেষ পর্যন্ত সিআইএর গুপ্তচর দ্বারা হাসপাতালে ইনজেকশনের মাধ্যমে বিষ প্রয়োগ করে তাকে হত্যা করা হয়। সেই তিনি বলেছিলেন- লাতিন আমেরিকার কবিদের টি.এস.এলিয়টের মতো কবিতা লিখলে চলবে না। আর গ্যাব্রিয়াল গার্সিয়া মার্কেজকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল- আপনি একজন লেখক হয়েও এতটা রাজনৈতিকভাবে সরব কেন? মাকের্জ বলেছিলেন- উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা ও শিল্পসাহিত্য উন্নত দেশের মতো নয়। আর তাই এসব প্রতিষ্ঠান ও সমাজকে পরিশুদ্ধ করতে উন্নয়শীল দেশের নাগরিক মার্কেজকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সোচ্চার হতে হয়েছে। অর্থাৎ এ দুজন লেখক শুধু সমসাময়িকভাবে সচেতন ছিলেনই না, বরং তারা রাজনৈতিকভাবে সোচ্চার ছিলেন। অনেকে জীবনান্দকে বলেন, তিনি নাকি সমসাময়িকতাকে এড়িয়ে গেছেন। অথচ জীবনানন্দের মতো সময় সচেতন পঞ্চপান্ডপদের আর কজন ছিলো? যিনি লিখেছেন, অদ্ভূত আঁধার এ পৃথিবীতে এসেছে আজ যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা যাদের হƒদয়ে প্রেম- নেই প্রীতি- নেই করুণার আলোড়ন নেই পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
আধুনিকতার সময় যদি আমরা সেই ১৯৫০ থেকে ধরি, তবে এ আধুনিকতার বয়স অর্ধশত বছরের বেশি। তাই বর্তমানে সাহিত্যে আধুনিকতা হচ্ছে তা, যা সমসাময়িকতা ধারণ করে ভবিষ্যতের দিকে পথ দেখায়। আর জাতিকে আগামীর বিপদ ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। কবিতা লিখতে গিয়ে শুধু ইলুউশন তৈরি করা, কোন মেসেজ না দেয় একের পর এক এমন গভীরতা সৃষ্টি করা, যাতে সাধারণ পাঠক কবিতা না বুঝতে পারে। অথবা গল্প লিখতে গিয়ে এমন গল্প লেখা, যাতে চিঠি আর রিপোটিংয়ে পার্থক্য না থাকা এবং পাঠকের জন্য না লিখে কবিতা বা কথাসাহিত্য বুঝতে পাঠকের প্রস্তুতির প্রয়োজন বলে শর্তারোপ করার কারণেই সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কবিতা ও কথাসাহিত্য থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। আর সাহিত্যে পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি হচ্ছে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া ও সমসাময়িক বিষয় এড়িয়ে চলার সুযোগ, যাতে কবি সাহিত্যিককে আর সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে না হয়। পাঠকের জীবন-জীবিকা, সমাজ বাস্তবতা, দেশপ্রেম ও দেশের জনগণের চাহিদা না বুঝে একটি স্বাধীন দেশে কবি সাহিত্যিক হওয়ার প্রচেষ্টা আত্মপ্রতারণা ছাড়া আর কি?
প্রায় তিন ঘন্টা সময়ব্যাপি চলা এই অনুষ্ঠানে আলোচকবৃন্দ ছাড়াও উপস্থিত ছিলো নানা বয়সের কবি সাহিত্যিক এবং সাহিত্যমোদি সাধারন মানুষ।
গ্রন্থনা : এমরান হোসেন

আরো পড়তে পারেন

সৈয়দা সালমা খায়েরের নতুন বই ‘মা’

এবারের বইমেলায় বেরিয়েছে কথাসাহিত্যিক সৈয়দা সালমা খায়েরের উপন্যাস ‘মা’। বইটি প্রকাশ করেছে সৃজন প্রকাশনি। পাওয়া যাবে বইমেলায় মাত্রাপ্রকাশের ৪৬৬ নাম্বার স্টলে এবং ঐতিহ্যের ২৫ নাম্বার প্যাভিলিয়নে। মা পৃথিবীর সবচাইতে আপন শব্দ। পৃথিবীর দীর্ঘতম স্নেহময় শব্দ। এই মায়ের সুখ-দুঃখ এবং জীবন-যন্ত্রণা নিয়ে লেখা ‘মা’ উপন্যাসে উঠে এসেছে একজন মায়ের করুণ কাহিনি। সন্তানের প্রতি মায়ের ত্যাগ, এই….

পিরোজপুর সাহিত্য পরিষদের অভিষেক ও দুটি কাব্যগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন

গত শনিবার (২৭ জানুয়ারি) বিকেলে পিরোজপুর সরকারি গণগ্রন্থাগারে পিরোজপুর সাহিত্য পরিষদের ২০২৪ সালের কার্যনির্বাহী পরিষদের অভিষেক ও দুইজন লেখকের প্রকাশিত বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়েছে। অনুষ্ঠানে পিরোজপুর সাহিত্য পরিষদের ২০২৪ সালের কার্যনির্বাহী সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন কবি দেলোয়ার হোসেন আলম ও কার্যনির্বাহী সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন কবি নজরুল ইসলাম এ সময় হাছিবুর রহমানের প্রথম লেখা কাব্যগ্রন্থ ‘ফিলিস্তিনের কান্না‘….

‘বাঙালি’ সাহিত্য পুরস্কার পেলেন শরাফত হোসেন

‘বাঙালি’ সাহিত্য পুরস্কার পেলেন কবি শরাফত হোসেন। শুক্রবার (২৫ নভেম্বর) জাতীয় জাদুঘরে আয়োজিত ‘বাঙালি’ সাহিত্য উৎসবে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি শিল্পী হাশেম খান পুরস্কার তুলে দেন। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন কথাশিল্পী হরিশংকর জলদাস। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. সরকার আবদুল মান্নান, কথাসাহিত্যিক রফিকুর রশীদ, কথাসাহিত্যিক….

error: Content is protected !!